প্রথম পাতা প্রবন্ধ তিন দেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথ

তিন দেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথ

349 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

বাঙলা ও বাঙালীর ঘরে বৈশাখ মাস পা রাখলেই মনের মধ্যে অনুরণিত হ’ন রবীন্দ্রনাথ। কারন, “হে নূতন দেখা দিক আর বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ… “, আসে ২৫ শে বৈশাখ।

বাঙালির সারাবছরের মননে,চিন্তনে নিত্য বা ইতস্তত রবী ঠাকুর ঘুরে ফিরে বারবার আসেন আর যান।কিন্তু সবিশেষ এই বৈশাখে তিনি যেন শুধু তিনি,শুধু তিনি…।

আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত ” জনগণ মন “-এর স্রষ্টা তিনি। ১৯১১ সালে এই গান তিনি রচনা করেন। ইমন রাগের ওপরে কাহারবা তালে এই গান তৈরী। প্রথম এই গান ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী ২৬ তম অধিবেশনে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সমবেতকণ্ঠতে গীত হয়।পরে এই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহন করার প্রস্তাব দেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালে। ১৯৪৩ সালে ৫ই জুলাই  সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর গঠনের প্রস্তাব করার সময়েও এই গান নেতাজীর তত্বাবধানে গীত হয়।  ১৯৪৩ সালের ২৫ শে আগষ্ট নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক সেনাপ্রধানের পদ গ্রহনের দিনও এই গান জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়েছিল সমবেতকন্ঠে এবং সুর বেজেছিল সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে।

পরে ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যুদ্ধে  আজাদ হিন্দ বাহিনীর জয় হয়,এবং বাহিনী প্রথম ভারতের মৌডাক ( উত্তর পূর্ব সীমান্তের) ভু-খন্ডে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করে এবং জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে

” জনগন মন ” গানটি গেয়েছিলেন বিজয়ী সেনানীরা।

তারপর সে এক ইতিহাস।পরে ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারী ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে এই গানটি স্বীকৃত হয়।যা আজও বহমান।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের জন্ম হওয়ার পরে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ বিশাল এক জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রস্তাব করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে কবিগুরুর “আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালোবাসি..” গানটি।এই গান রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৯০৫ সালে  ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের সময়ে। কলকাতার টাউন হলে এই গান ১৯০৫ সালে ৭ ই আগস্ট সমবেতভাবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল  বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার  ময়দানে কোটি কোটি বাঙালী জনতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে শপথ নিয়েছিল। সেদিন “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি… ” গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে  কোটি কোটি উপস্থিত বাঙ্গালী  গেয়েছিল।

২০১৪ সালে ২৬ শে মার্চ এই গানটি ঢাকার জাতীয় প্যারেড  গ্রাউন্ড-এ  ৪ লক্ষ ৫৪ হাজার ৫৩৭ জন বাঙালী (যাদের মধ্যে বাংলাদেশের বাঙালী  এবং সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশে  থাকা বাঙালী ছিল..) সমবেতকণ্ঠতে এই গানটি গেয়েছিলেন। যা  গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড-এ স্থান পেয়েছে।

লণ্ডনের বি.বি.সি.তে সারা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় ২০ টি গানের তালিকায় প্রথম স্থান পেয়েছে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি.. ” গান টি।

আমাদের আর এক প্রতিবেশী  দেশ শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হোল..” নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা..” গানটি।

এই গানটির সাথেও রবীন্দ্রনাথ যুক্ত এবং তার সাথে আর একজন যুক্ত,তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম ছাত্র আনন্দ সামারাকুন। আনন্দ ছিলেন শ্রীলঙ্কার এক খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী ছিলেন। ১৯৩০ সালে আনন্দ শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত ও চারুকলা নিয়ে পড়তে আসেন।রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৩৮ সালে আনন্দ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে তার দেশের জন্যে একটি গান তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কবিগুরু প্রিয় ছাত্রের সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন…

” নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা…” গানটি বাংলায় লিখে নিজে সুর দিয়ে এবং সেই সুর আনন্দের গলাতেও তুলে দিয়েছিলেন।

১৯৪০ সালে আনন্দ সামারাকুন নিজের দেশ শ্রীলঙ্কায় ফিরে যান।

১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা পায়। ১৯৫০ সালে নতুন দেশের জাতীয় সঙ্গীত ঠিক করার জন্য স্যার এডুইন ওয়াসজার এটনি-র নেতৃত্বে সে দেশের সরকার একটি কমিটি গঠন করেন। ইতিমধ্যে আনন্দ সামারাকুন শ্রীলঙ্কার একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতকার এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন সেদেশে। তখন তিনি “নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা..” গানটি সিংহলী ভাষায় অনুদিত করে সুরটি অক্ষত রেখে কমিটির কাছে জমা দেন,এবং ১৯৫১ সালের ২২ শে নভেম্বর  সেই গানটিকেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে সমর্যাদায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়।গানটি সিংহলী ভাষায় অনুদিত করেন আনন্দ সামারাকুন,আর তামিল ভাষায় অনুদিত করেন এম.নালাথাম্বি। তিন তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত স্রষ্টা হলেন রবীন্দ্রনাথ। যা এই বিশ্বে আর কেউ নেই। তাই তিনি শুধু বাংলার নন,ভারতের নন,তিনি এই বিশ্বের,এই ব্রম্ভান্ডের….তিনি যথার্থভাবেই আন্তর্জাতিক।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.