প্রথম পাতা প্রবন্ধ সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রাণশক্তি ও সৃষ্টিশক্তির প্রতীকরূপে, মাতৃদেবী হিসাবে নানারূপে,নানাভাবে পূজিতা তিনি

সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রাণশক্তি ও সৃষ্টিশক্তির প্রতীকরূপে, মাতৃদেবী হিসাবে নানারূপে,নানাভাবে পূজিতা তিনি

183 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের দেশে এবং সারা বিশ্বে সভ্যতার সেই আদিকাল থেকেই মাতৃরূপে এই পৃথিবী শ্রদ্ধায়,সাদরে বিরাজ করেছেন মানুষের ভাবনায় চিন্তায়। যা আজও বহমান। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রাণশক্তি ও সৃষ্টিশক্তির প্রতীকরূপে মাতৃদেবী হিসাবে নানারূপে,নানাভাবে পূজিতা।

সিন্ধুসভ্যতার প্রাক্-যুগেও এর প্রামাণ্যতা পাওয়া যায়। মেসোপটেমিয়ান সভ্যতায়,মিশরীয় সভ্যতায়,গ্রীক সভ্যতায় এই ভাবনার প্রমান আছে। বৈদিক  সাহিত্যে তাই দেবীস্তবের মাধ্যমে এই বসুন্ধরার মাতৃত্বকে এবং দেবীত্বকে মহিমাণ্বিত করা হয়েছে। মন্দ্রিত কণ্ঠে প্রাচীন ঋষি উচ্চারন করেছেনঃ–“মাতা পৃথ্বিমহীয়ং”..বিস্তীর্ণ পৃথিবী তুমিই আমাদের মা ( ঋক্ বেদ/১-১৬৪/৩৩)। অথর্ব বেদেও সন্তানবৎসলা মঙ্গলময়ী মা হিসাবে এই বসুমাতার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। আদিকবি মহর্ষি বাল্মিকী  মানসকন্যা সীতাকে( সীতা মানে লাঙ্গলের ফলা) ধরণীদুহিতা হিসাবে মৃন্ময়ী পৃথিবীকে চিন্ময়ী  রূপে মহাকাব্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ঐতরেয় উপনিষদেও এই ধরিত্রী সূর্যস্নাতা শ্রীরূপে এবং চন্দ্রস্নিগ্ধা লক্ষ্মী-রূপে সমাদৃতা। শস্য-পালনী ধরিত্রীর পুজো থেকেই শস্য-দায়িনী দেবী এবং শস্য পুজোর উদ্ভব হয়েছিল।তাই আমাদের দেবী আরাধনায় এই শস্য পুজো(নবপত্রিকা-সহ// ধান,কলা,কচু,মানকচু,হলুদ,বেল,ডালিম,অশোক,জয়ন্তীঃএই ন’টি গাছের পাতা দিয়ে তৈরী নারীমূর্তি, যাকে কলাবউ বলা হয়) সংযুক্ত। সেইজন্যই বর্ষার শেষে শরৎকাল থেকে সেই বসন্তকাল অবধি শস্যঋতুর অবস্থিতি।এই সময়কালেই তাই আমাদের দেশে দেবীপুজোর আয়োজন করা হয়–শারদীয়া দুর্গাপূজা, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো,কালীপূজো, জগদ্ধাত্রীপুজো,ইতুপুজো, সরস্বতীপূজো,অন্নপূর্ণা পুজো,বাসন্তীপুজো(বসন্তকালের দুর্গাপূজো)।

শারদীয়া উৎসবের সময়ে ভারতের উত্তরাংশে মহালয়ার পরের দিন থেকে “নবরাত্রি” পালন করা হয়। এই নবরাত্রি-র সঙ্গে দেবী মা দুর্গার নয়টি রূপের প্রকাশে “নবদুর্গা “-র পুজাও করা হয়।

এই নয়টি রূপ হোলঃ প্রথম রূপে দেবী  “শৈলপুত্রী”, দ্বিতীয় রূপে দেবী  “ব্রহ্মচারিনী”, তৃতীয় রূপে দেবী “চন্দ্রঘণ্টা”,  চতুর্থ রূপে দেবী ” কুষ্মাণ্ডা”, পঞ্চম রূপে   দেবী “স্কন্দমাতা”,  ষষ্ঠ রূপে  দেবী  “কাত্যায়নী”, সপ্তম রূপে দেবী  “কালরাত্রি”, অষ্টম রূপে দেবী “মহাগৌরী”, নবম রূপে দেবী “সিদ্ধিদাত্রী”।

দক্ষিণ ভারতীয়  শারদ নবরাত্রি তথা নবদুর্গা পুজোর সঙ্গে মাটির পুতুল তৈরী করে উৎসব পালন করা হয়,তার নাম ” গোলু”। এই “গোলু” দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে “বুম্বে হাব্বা”নামে, “বোম্মালা কোলুভু” নামে, “বোম্মা কোলু”

নামেও পরিচিত। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা,কর্নাটক ছাড়াও এই প্রথা শ্রীলঙ্কাতেও পালিত হয়। শ্রীলঙ্কায় এই উৎসবকে বলা হয় “মারাপাচ্চি”। দশ দিন ধরে সেখানে এই উৎসব পালন হয়।

আমাদের এই বঙ্গে দুর্গাপূজার  আনন্দ উৎসব আজ এক ঐতিহ্যে,পরম্পরায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। মহালয়ার ভোরে বাণীকুমার রচিত সেই গীতিআলেখ্য.. “মহিষাসুরমর্দিনী”-র  বীরেন ভদ্রের স্তোত্রপাঠ এবং তার সাথে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে স্তোত্রগান… এক অনিন্দ্যসুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি করে।যা আমাদের শৈশবের যৌবনের, মাঝ বয়সের,প্রবীণ  বয়সের নানা স্মৃতিতে, এক রোমাঞ্চিত আগ্রহান্বিত ভালোবাসায় নতুন সুপ্রভাত হয়ে পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে এই বাংলায় শিউলির গন্ধে,কাশফুলের দোলায়,নীল আকাশের মেঘেদের পালকিতে,পালকিতে,মেঘ-রোদ্দুরের আলোছায়ায়। ফিরে ফিরে আসে বাংলার ঘরে ঘরে মা দুর্গার আগমনী গানের সুরে সুরে। সারা বছরের নানা দুঃখ কষ্টের মধ্যে কয়েকটা দিনের জন্য আনন্দের ছাড়পত্র নিয়ে আসে উমা,যিনি আমাদের কাছে যেমন দেবী, তেমনই তিনি আমাদের ঘরের পরিচিত  অতি আদরের মেয়ে। সেই মেয়ে উমা যেমন  আসেন মা মেনকার কাছে, বাপের বাড়িতে… ঠিক তেমনই আমাদের সারা বাংলায় আটপৌরে সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত বাঙালী ঘরের অসংখ্য আদরের মেয়েরা এই কটা দিন কাটিয়ে যান তাদের মা-বাবার কাছে,এক আশৈশব পেতে রাখা  ভালোবাসার নকশীকাঁথায় স্নেহের, সমাদরের, অপত্য সম্পর্কের আকর্ষণে…। 

কবির কথায়ঃ

“চিন্ময়ী রূপে দুর্গা থাকে আমার ঘরের ঘেরা-টোপে,

আবার তাকেই দেখি মৃন্ময়ী রূপে শারদীয়া মণ্ডপে।

তাই তো দুর্গা আমার ঘরে-বাইরে, দুর্গা আমার বুকে

দেবী মায়ের রূপটি দেখি ‘মা-বোন-জায়া-কন্যা’-র মুখে।”

আসন্ন শারদীয়া উৎসবের দিনগুলিতে সবাই আনন্দে থাকুন,ভালো থাকুন। অশুভ ভাইরাসুরের আক্রমন প্রতিহত করতে কোভিড বিধি নিয়ম মেনে চলুন।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonliy24. All Right Reserved.