পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
১৮৫৭ সাল।২৯শে মার্চ। কলকাতার উপকণ্ঠে ব্যারাকপুর (এখনকার উত্তর ২৪ পরগনা) মিলিটারী ব্যারাকের প্যারেড গ্রাউন্ড। সেদিন সেখানে ঘটেছিল এক ঐতিহাসিক বিদ্রোহ।
সেদিন ৩৪তম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের অন্যতম সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট মিঃ বৌগ-এর (Boug) কাছে হঠাৎ খবর গেল যে,তার রেজিমেন্টের বেশ কয়েকজন সিপাহী প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?
আসলে, এমনিতেই গত ১০০ বছর ধরে (১৭৫৭ সালের নদীয়ার পলাশীর যুদ্ধে তখনকার বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা-কে এক বিশ্বাসঘাতকতা করে, এক ঐতিহাসিক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে, পরাজিত অবস্থায় খুন করে ব্রিটিশরা এদেশে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। এবং পাশাপাশি তারা এদেশীয় সাধারন মানুষকে, এদেশের সেই সময়ের সামন্ত স্বাধীন রাজা,জমিদার প্রমুখদের ওপরে দিনের পর দিন নানান অছিলায় দখলদারি, খুন,গুপ্তহত্যা,লুটতরাজ,ধর্মান্তকরণ,ইত্যাদি বিভিন্নধরনের অত্যাচার অনাচার শুরু করেছিল।তাতে এদেশের মানুষের মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভের আগুন তুষেরআগুন হয়ে ধিকিধিকি করে জ্বলছিল।
তার-ওপর,বেশ কিছুদিন ধরে সিপাহীদের মধ্যে খুব গোপনীয়ভাবে একটা কথা প্রচার হয়েছিল যে,তারা যে বন্দুকের গুলি(টোটা) ব্যবহার করতেন–যা তারা প্রথমে তাদের দাঁত দিয়ে ক্যাপসুল ছিঁড়ে বন্দুকে ঢোকাতে হতো, তাতে গরু,শুয়োরের চর্বি মেশানো থাকে।এরফলে সিপাহীদের মধ্যে তলেতলে মারাত্মক ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল।হিন্দুরা গরুর চর্বিকে আর মুসলমান-রা শুয়োরের চর্বিকে হারাম্ মনে করতেন। তারা ভাবলেন যে,ব্রিটিশরা তাদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে,অপমান করছে তাদের পরম্পরাকে। এই ক্ষোভ বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। ব্যারাকপুরের ব্যারাকে,লখ্নৌ ব্যারাকে,দিল্লির ব্যারাকে,মহীশুর ব্যারাকে,মহারাষ্ট্র ব্যারাকে,ইত্যাদি ইত্যাদি জায়গায়। সেই ক্ষোভ থেকেই বদলা নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার চরম এবং প্রবল এক মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছিল সিপাহীদের মনের মধ্যে। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চের বিকেলবেলায় কলকাতার ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে এই ঘটনার সুত্রপাত।
যাইহোক, লেফটেন্যান্ট বৌগের কাছে খবর গেল যে,ব্যারাকপুর সেনা ব্যারাকের প্যারেড গ্রাউন্ডে বেশ কয়েকজন সিপাহী বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে,এবং তারা একজায়গায় সমবেতও হয়েছে।
খবর পাওয়া মাত্রই বৌগ ঘোড়ায় চড়ে সেখানে ছুটে যায়।তার কাছে খবর ছিল যে,মঙ্গল পাণ্ডে নামে এক বিদ্রোহী সশস্ত্র সিপাহী গার্ডরুমের সামনে রয়েছেন,আর তার পেছনে রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী সিপাহী। মঙ্গল পান্ডের হাতে রয়েছে বন্দুক,সে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছে,এবং সে প্রথম একজন সাদা চামড়ার ব্রিটিশকে গুলি করবেই।ইতিমধ্যে সেই সময়ে ব্যারাকপুর ছাউনির পাশে গঙ্গানদীতে একটি স্টীমারে কয়েকজন ব্রিটিশ সৈন্য আসছে। এই খবরও ছিল ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে।ফলে, অবস্থা তখন ভয়াবহ এক চরম পর্যায়ে। একদিকে বিদ্রোহী সশস্ত্র সিপাহী মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহী হুঙ্কার,অপরদিকে আগত নিরস্ত্র ব্রিটিশ সৈন্যরা,মাঝখানে মিঃ বৌগ।
ঠিক সেইসময় মঙ্গল পান্ডে বৌগ-কে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি লাগে বৌগের ঘোড়ার গায়ে,ঘোড়া তখন লাফিয়ে উঠে বৌগ-কে মাটিতে ফেলে দেয়। বৌগ তার পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মঙ্গল পান্ডের দিকে এগিয়ে যায়।কিন্তু বৌগ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।তখন বৌগ তার তলোয়ার বের করে মঙ্গল পান্ডেকে আক্রমণ করতে যায়,কিন্তু তার আগেই মঙ্গল পান্ডে নিজের তলোয়ার দিয়ে বৌগ-কে ক্ষত-বিক্ষত করে মাটিতে ফেলে দেয়।সেই সময়ে বৌগ মঙ্গল পান্ডেকে ধরার জন্যে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিপাহী শায়ক পল্টুকে নির্দেশ দেয়।কিন্তু পল্টু অপারগ বলে জানিয়ে দেয়।বৌগ তখন অন্যান্য সিপাহীদের ডাকে,কিন্তু তারা সমস্বরে বলে ওঠে,যে তারা মঙ্গল পান্ডেকে ধরতে পারবে না।
সেইসময় মিঃ হিউসন নামে একজন অপর ব্রিটিশ মেজর সার্জেণ্ট সেখানে পৌঁছে যায়। তখন কোয়ার্টার গার্ডের ভারতীয় জিমাদার ঈশ্বরী প্রসাদকে হিউসন অর্ডার কোরে বলে যে সে যেন মঙ্গল পান্ডেকে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরীপ্রসাদ বলে দেন যে তিনি মঙ্গল পান্ডেকে কখনোই ধরতে পারবেন না। বিদ্রোহী সিপাহী মঙ্গল পান্ডে তখন উল্কার বেগে আগুনের গতিতে বন্দুক নিয়ে ব্রিটিশ অফিসারদের তাড়া করে বেড়াচ্ছেন। ভয়ে পালাচ্ছে ব্রিটিশ অফিসাররা। ভাবা যায় গত ১০০ বছরে এই প্রথম ব্রিটিশ সরকারের সেনা অফিসাররা প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।উপস্থিত ব্যারাকের সিপাহীদের সে কি আনন্দের উল্লাস,আর বিক্ষোভের ধিক্কার।
যাইহোক, এরপর হিউসন মঙ্গল পান্ডের সামনাসামনি হলে মঙ্গল তাকে বন্দুকের বাঁট্ দিয়ে মারাত্মক আঘাত করে,এবং হিউসনের মাথা,মুখ ফেটে যায়,সে মাটিতে পড়ে যায়। তখন কোনরকমভাবে বৌগ ছুটে এসে…”সে কোথায় সে কোথায়…” বলে লম্ফঝম্প করতে লাগল।আবার মঙ্গল পান্ডে তাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিঠে,কোমরে মারে,সে পড়ে যায়। তখন কিছুক্ষণের জন্য সে এক মহাপ্রলয় কান্ড। সবাই দেখছে ব্রিটিশ সরকারের অফিসারদের দুর্দশা।
ততক্ষনে আরও ব্রিটিশ অফিসাররা সেখানে চলে এসেছে।তারা দূর থেকে অন্যান্য সিপাহীদের বলছে পান্ডেকে ধরার জন্যে।তারা কিন্তু কেউই সে কথা মানছে না,শুনছে না। এরই মধ্যে শায়ক পল্টু পেছন থেকে মঙ্গল পান্ডে-র একটা হাত হঠাৎ ধরে ফেলে এবং অন্যান্য সিপাহীদের ডাকে তাকে সাহায্য করার জন্যে,কিন্তু সাহায্য তো দুরের কথা,তখন অন্যান্য সিপাহীরা পল্টুকে পাথর ছুঁড়ে,জুতো ছুঁড়ে মারতে থাকে এবং আক্রমণ করে,এবং পল্টুকে হুমকি দিয়ে শাসায়,যে, মঙ্গল পান্ডে-কে সে যদি ছেড়ে না দেয়,তাহলে তারা গুলি করে পল্টুকে হত্যা করবে।
ইতিমধ্যে সেনা ব্যারাকের অন্যান্য ব্রিটিশ অফিসাররা চলে এসেছে,চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে বিদ্রোহী সিপাহী মঙ্গল পান্ডে-কে সেদিন তারা অতি কষ্টে ধরতে পেরেছিল। সিপাহীরা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে শায়ক পল্টুকে হত্যা করে,গুলি লাগে বেশ কিছু অফিসারের হাতে,পায়ে।কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার সাথেসাথেই মঙ্গল পান্ডে তার নিজের বন্দুকের ট্রিগার টিপে নিজেকে গুলি করে,গুলি লাগে তার রেজিমেন্টের জ্যাকেটে, জ্বলে যায় জ্যাকেট,–প্রচুর রক্তপাত হতে থাকে মঙ্গল পান্ডের শরীর থেকে।ব্রিটিশ অফিসাররা তখন অকথ্য অত্যাচার করতে শুরু করে মঙ্গল পান্ডের ওপরে।মঙ্গল পান্ডে মারাত্মকভবে আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যান।পরাধীন মাতৃভূমি সেদিন প্রথম রক্তস্নাত হয়েছিল তার বিদ্রোহী সন্তানের পবিত্র পূণ্য শোণিতধারায়.., স্বাধীনতার শপথ নিয়েছিল ভারতবর্ষের গণদেবতা।
এরপর বিচারের নামে প্রহসন। বিচারে মঙ্গল পান্ডের ফাঁসীর হুকুম জারি হয়।আর তার সাথে ঈশ্বরী প্রসাদেরও ফাঁসীর হুকুম জারি হয়।
১৮৫৭ সালের ৮ই এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যারাকপুর সেনা ব্যারাকে ভারববর্ষের সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম বিদ্রোহী শহীদ সন্তান মঙ্গল পান্ডের ফাঁসী হয়।আর তার তিনদিন পরে ১১ই এপ্রিল শহীদ ঈশ্বরী প্রসাদের ফাঁসী হয়।
কিন্তু কে এই সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক মঙ্গল পান্ডে?
১৮২৭ সালের ১৯শে জুলাই,উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার নাগওয়া গ্রামে এক অত্যন্ত গরীব পরিবারে মঙ্গলের জন্ম। শহীদ জননীর নাম অভয়ারানী দেবী,আর শহীদ পিতার নাম দিবাকর পান্ডে। মঙ্গল অনেক কষ্ট করে ইস্কুলের গন্ডি পার করে সংসারের জন্য আর লেখাপড়া না করে ২২ বছর বয়সে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বেঙ্গল আর্মিতে সিপাহী পদে যুক্ত হন। সেনা ছাউনির সকলে মঙ্গল পান্ডেকে খুব ভালোবাসতেন।কারন মঙ্গল ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র,নম্র,শান্ত প্রকৃতির মানুষ।ডিউটি ছাড়া প্রায় সব সময়েই পূজা-অর্চনা নিয়ে থাকতেন। সকলের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতেন। কিন্তু,দিনের পর দিন ব্রিটিশদের অত্যাচার,অন্যায় অবিচার মঙ্গল পান্ডেকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।তিনি দেখেছিলেন, কিভাবে ব্রিটিশ সেনা অফিসারা ছাউনির সিপাহীদের ওপরে নানা অছিলায় অমানবিক অত্যাচার করতো,মা-বাবা,দেশ,জাতি, জন্ম তুলে অশ্রাব্য গালাগালি দিত। এসবের প্রতিবাদ মঙ্গল মাঝেমধ্যেই করতেন। ফলে ব্রিটিশের আক্রোশ গিয়ে পড়তো মঙ্গল পান্ডের ওপর।
পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রথম শহীদ হন মঙ্গল পান্ডে।যা পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের দেশব্যাপী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অগ্নিস্নাত অগ্নিমন্ত্রের মাইলফলক হিসাবে এদেশের ইতিহাসে লেখা আছে,ছিল,এবং অবশ্যই থাকবে।
বন্দেমাতরম….ইনকিলাব জিন্দাবাদ…. শহীদ মঙ্গল পান্ডে জিন্দাবাদ.…মঙ্গল পান্ডে অমর রহে।
শহীদ ঈশ্বরী প্রসাদ জিন্দাবাদ…ঈশ্বরী প্রসাদ অমর রহে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে (মৃত্যুর আগে).. “সিপাহী বিদ্রোহ” কবিতা, যা বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের সাহিত্যে প্রথম এবং একমাত্র লেখা..”হঠাৎ দেশে উঠলো আওয়াজ—
“হো-হো,হো-হো,হো-হো”//
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে
সিপাহী বিদ্রোহ! “
সিপাহি বিদ্রোহের অমর শহীদ মঙ্গল পান্ডে…তোমায় প্রণাম,তোমায় সালাম…
শহীদ ঈশ্বরী প্রসাদ..তোমায় প্রণাম,তোমায় সালাম।